হাইতির রাজধানী পোর্ট অব প্রিন্সে আমার এক বন্ধু আছেন। সম্প্রতি মুঠোফোনে আমাকে একটি বার্তা পাঠান তিনি। তাতে লিখেছেন, ‘পোর্ট অব প্রিন্স এখন আতঙ্কের এক নগরী।’
পোর্ট অব প্রিন্সের একটি অভিজাত এলাকা পেটিওনভিল। দেশজুড়ে চলমান নিরাপত্তা সংকটের মধ্যে এযাবৎকালে সবচেয়ে সহিংস দিনটি প্রত্যক্ষ করে সেখানকার বাসিন্দারাও আতঙ্কে কুঁকড়ে গেছেন। গুলিবিদ্ধ এক ডজনের বেশি মরদেহ পড়ে আছে সড়কে। দেশটিতে সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্রের (গ্যাং) সদস্যরা সর্বশেষ যে তাণ্ডব চালিয়েছে, তারই শিকার এই ব্যক্তিরা।
ভোরবেলা গ্যাং সদস্যদের হত্যাযজ্ঞের মধ্যে সেদিন এক বিচারকের বাড়িতেও হামলা হয়। রাষ্ট্রক্ষমতার জন্য দেশটির যে অভিজাত শ্রেণি নানা ফন্দিফিকির করছে, তাদের কাছে এটা ছিল স্পষ্ট একটি বার্তা। সব ঘটনাই ঘটেছে শহরে সবচেয়ে নিরাপদ হিসেবে পরিচিত একটি এলাকায়।
হাইতির বর্তমান পরিস্থিতিকে ভয়ংকর বলে বর্ণনা করেছেন জাতিসংঘের শিশু তহবিলের (ইউনিসেফ) নির্বাহী পরিচালক ক্যাথেরিন রাসেল। হাইতির চরম এই অরাজক পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ, তা বোঝাতে সভ্যতা ধ্বংস হওয়ার পর কী অরাজকতা হতে পারে, সেই কল্পনার ভিত্তিতে নির্মিত চলচ্চিত্র ‘ম্যাড ম্যাক্স’-এর সঙ্গে এর তুলনা টেনেছেন তিনি।
পোর্ট অব প্রিন্সের সর্বশেষ এই সহিংসতা সতর্কবার্তা হতে পারে যে স্থিতিশীলতা নয়, হাইতি অরাজকতার দিকেই ঝুঁকে আছে। তবে আদতে এই সতর্কবার্তা অনুধাবন বা আমলে নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করার মতো কেউ আছেন কি না, সেটাও একটা বড় প্রশ্ন।
সহিংসতার কারণে সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েছেন অন্তঃসত্ত্বা নারীরা। ব্যাপক সহিংসতার মুখে অনেক হাসপাতালে সেবাদান বন্ধ। জাতিসংঘের অনুমান, এতে কোনো প্রসূতিসেবা ছাড়াই সন্তান জন্মদানের ঝুঁকিতে আছেন অন্তত তিন হাজার নারী।
হাইতির উত্তর উপকূলীয় বন্দরনগরী কেপ হাইতিয়েনের সরকারি হাসপাতালের প্রসূতি ওয়ার্ড পরিদর্শনে গিয়েছিলাম আমরা। ওয়ার্ডে ঢুকেই বেবি উডলি নামের এক দিন বয়সী একটি নবজাতকের কান্না শুনি। পুরো হাইতির অন্য অনেক শিশুর মতো সেই নবজাতকও হয়তো খাবারের জন্য, একটু ভালো পরিবেশের জন্য কাঁদছিল। শিশুটি হয়তো জানে না যে দেশের অধিকাংশ শিশুর মতো তারও খাবারের মতো জরুরি অনেক কিছু পাওয়ার নিশ্চয়তা নেই হাইতিতে।
বেবি উডলির পাশের শয্যায় কাতর হয়ে শুয়ে ছিলেন মারকিনসন জোসেফ নামের এক নারী। দুই দিন আগে সন্তান প্রসব করেছেন তিনি। সেই ধকল তখনো তাঁর চোখেমুখে দেখা গেল। একজন দোভাষীর মাধ্যমে কথা বলার পর তিনি বললেন, যদি সুযোগ পান, তাহলে শিশুটিকে নিয়ে সপরিবার অন্য কোনো দেশে পালিয়ে যাবেন। মারকিনসন বললেন, ‘কিন্তু দেশ ছাড়ার জন্য যে অর্থ প্রয়োজন, তা আমি বা আমার স্বামী কারও কাছেই নেই।’
হাসপাতালের প্রসূতিবিশেষজ্ঞ মারদোচে ক্লেরভিলের সঙ্গে দেখা হলো। তিনি আমাদের হাসপাতাল ঘুরিয়ে দেখালেন। দেখলাম, চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। শয্যাগুলো খালি পড়ে আছে। ক্লেরভিল জানান, যেসব সড়ক দিয়ে রাজধানীতে যাওয়া-আসা করতে হয়, সেগুলো এখন গ্যাং সদস্যদের নিয়ন্ত্রণে। এ কারণে হাসপাতালে জ্বালানি আসছে না। ফলে আলো জ্বলছে না, পাখাও ঘুরছে না। ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জামও আনা সম্ভব হচ্ছে না। তিনি আরও জানান, তুলনামূলক নিরাপদ হওয়ার কারণে পোর্ট অব প্রিন্স থেকেও অন্তঃসত্ত্বা মায়েরা এখানে আসতেন সন্তান জন্মদানের জন্য।
পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা শিক্ষানবিশ চিকিৎসক ও নার্সদের দিকে ইঙ্গিত করে ক্লেরভিল বলেন, ‘আপনারা দেখুন, আমাদের এখানে শয্যা ও সেবা দেওয়ার মতো যথেষ্ট লোকবল আছে। কিন্তু রোগীরাই তো হাসপাতাল পর্যন্ত আসতে পারেন না।’ এর কারণ হিসেবে সহিংসতার পাশাপাশি আর্থসামাজিক সমস্যার কথাও বললেন এই চিকিৎসক।
এ পরিস্থিতি অনেকের জীবনে ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনছে। লুইজিমেনি নামের এক নারী যখন হাসপাতালে আসেন, তখন তিনি আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা। ততক্ষণে তাঁর উচ্চ রক্তচাপ বিপজ্জনক মাত্রায় পৌঁছেছে এবং গর্ভের সন্তানকে বাঁচাতে পারেননি তিনি।
চিকিৎসকের পর্যবেক্ষণে থাকলে অথবা আগেই সন্তান প্রসবের ব্যবস্থা করা গেলে হয়তো অনাগত সন্তানকে হারাতে হতো না লুইজিমেনিকে। চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, লুইজিমেনি যদি একটু সচেতন না হতেন, তাহলে নাকি তাঁকেও বাঁচানো যেত না।
লুইজিমেনি বললেন, ‘গত জানুয়ারির শুরু থেকে ওষুধ খাওয়ার ওপর বেঁচে আছি। কিন্তু এ সময়ে আমাকে অন্তত তিনটি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হয়েছে।’
পুরো হাইতিতে এখন মানবিক সাহায্য জরুরি হয়ে উঠেছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, এখন পর্যন্ত দেশটিতে সামান্য কিছু ত্রাণসহায়তা দেওয়া হয়েছে, যার গতিও খুব ধীর।
দেশটির লাখ লাখ মানুষের কাছে জীবনধারণের জন্য জরুরি খাবার, পানি ও নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজ পাওয়াটা দুরূহ হয়ে উঠছে। তাঁদেরই একজন পোর্ট অব প্রিন্সের বাসিন্দা ফারাহ অক্সিমা। গ্যাং সদস্যদের নিয়ন্ত্রণে থাকা শহরতলি একটি এলাকায় তাঁদের বাড়ি। সহিংসতার কারণে ৯ সন্তানকে নিয়ে বাড়িঘর ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছেন এই নারী। তাঁদের মতো আরও সাড়ে তিন লাখের বেশি মানুষ ইতিমধ্যে বাড়িঘর ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছেন।
সড়কে বসানো একটি পাইপ থেকে প্লাস্টিকের পাত্রে পানি নিচ্ছিলেন ৩৯ বছর বয়সী ফারাহ অক্সিমা। জানালেন, সন্তানদের একটু খাবার আর পানি দেওয়ার জন্যও এখন ধুঁকতে হচ্ছে তাঁকে। বললেন, ‘আমি জানি না কী করার আছে। দেশটাকে চোখের সামনেই ধ্বংস হতে দেখছি।’
ফারাহর মতে, অন্তর্বর্তীকালীন একটি পরিষদ গঠন করে স্বল্পমেয়াদে হলেও শৃঙ্খলা ফেরানো এবং নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার যে কথা বলা হচ্ছে, তা একেবারেই অসম্ভব।
ফারাহ বললেন, ‘একমাত্র ঈশ্বরই এখানে পরিবর্তন আনতে পারেন। কারণ, আমি এখন যে অবস্থানে আছি, তাতে কোনো পরিবর্তন আসছে, তা আমি দেখতে পাচ্ছি না।’
Post a Comment